আমাদের বাস্তব ও বিজ্ঞান — মনোরঞ্জন ঘোষাল | Bijnan-O-Bijnani

Sayantani Banerjee
6 min readJan 13, 2021

প্রতি বছরই জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস দুটিতে নানা বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় আমাদের দেশে। কারণ জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহটি (৩-৭ তারিখ) পালিত হয় Indian Science Congress সপ্তাহ হিসাবে এবং ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখ পালিত হয় National Science Day হিসাবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী ওয়েবজিনেও কিছু বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি।

বিজ্ঞান শুধু পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে তা সার্বিক উন্নতির কাজে লাগেনা। সেই জ্ঞান সকলের মাঝে ছড়িয়ে না দিলে সাধারণ মানুষ চিরকালই অজ্ঞ হয়ে থাকেন, বিজ্ঞানের সঠিক ব্যবহারটা তারা আর করে উঠতে পাড়েন না। আর সেই বিষয় নিয়েই মনোরঞ্জন ঘোষাল-এর এই লেখা।

বিজ্ঞানের কোন থিওরি-গত বিদ্যা ও তার প্র্যাকটিক্যাল দুটোর মধ্যে রয়েছে আকাশ জমিন ফারাক

বাস্তব বড় কঠিন। আরো কঠিন সেই বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া। যে মা ঠাকুরমারা তাদের জীবনের সমস্ত সময় রান্নাঘরে রান্না করতে কাটিয়ে দেন রান্না করে। তাকে দু’কলম লেখাপড়া শেখা ছেলের কাছে থেকে আলু ভাতে গরম হাওয়া কে কিভাবে ঠান্ডা করতে হয় তা যদি শিখতে হয় এ কথাটা আমি মেনে নিতে পারি না। বরং প্রতিনিয়তই আমরা দেখেছি সেই অশিক্ষিত মা ঠাকুরমারা কিভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের শিখিয়ে দেন যে গরম জিনিস কে ঠান্ডা করার জন্য আমাদের বিজ্ঞান জানা মানুষের থেকে তারা অনেক অংশেই এগিয়ে। তারা হয়তো আমাদের মত বিজ্ঞানকে গুছিয়ে বলতে বা লিখতে জানেন না বা তার সত্য অসত্য তা আমাদের মত পরিবেশন করতে পারেন না। কিন্তু তাই বলে তিনি যে বিজ্ঞান সত্য জানেন না বা সেই সম্পর্কে তিনি একেবারেই অজ্ঞ একথা মানা যায় না।

এই জায়গাতেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের বারবার শিখিয়ে দেয় যে বিজ্ঞানের কোন থিওরি-গত বিদ্যা ও তার প্র্যাকটিক্যাল দুটোর মধ্যে রয়েছে আকাশ জমিন ফারাক। যে ফারাক টি তুলে ধরার জন্য আমাদের দীর্ঘ সুসভ্য কাল সময় লেগে গেল।

রান্নার সময় কড়াইতে একাধিক মাছের টুকরোকে পাশাপাশি রেখে ভাজার সময় টুকরোগুলো গরমে পরস্পর কেমন জোড়া লেগে যায় কেন?

বিজ্ঞানীরা আজ অনেকেই বুঝতে পারছেন যে জীববিজ্ঞানীদের প্রোটিন অনুগুলি গরম অবস্থায় সঙ্গবদ্ধ হয়ে যায় তা যে তারা আজ নতুন করে আবিষ্কার করেছে এ কথাটা ঠিক নয়। কোয়াসারভেট তত্ত্বের মাইক্রোস্ফিয়ার গঠন ইত্যাদি ঘটনা আমরা নতুন করে বিজ্ঞানীদের কাছে শিখছি বটে। তাই বলে এই ঘটনা যে বিজ্ঞানী ফক্স প্রথম দেখেছেন এ কথাটা স্বীকার করা যায় না।

রান্নার সময় কড়াইতে একাধিক মাছের টুকরোকে পাশাপাশি রেখে ভাজার সময় মা ঠাকুমারা প্রায়শই দেখেছেন যে সেই মাছের টুকরোগুলো গরমে পরস্পর কেমন জোড়া লেগে যায়। সুতরাং প্রোটিন অনু গুলি যে তাপ পেলে পরস্পর জোড়া লেগে যেতে পারে এ ঘটনা আমাদের থেকে বহু আগেই অশিক্ষিত মা ঠাকুমারা রান্নার কড়াইতে বসে শিখে গেছেন। তবে তারা সেই জ্ঞান বিজ্ঞানের কোন সুবিধা তে লাগাতে সফল হয়নি। কিন্তু তাই বলে সেই জ্ঞান যে সীমাবদ্ধ থেকেছে শুধু তারমধ্যে এ কথাটা স্বীকার করা যায় না। সেই জ্ঞান একাকী মা ঠাকুমার থেকে দিদি এবং অন্যান্য মা ঠাকুমা। আত্মীয় পরিজন রান্নাবান্নার সমস্ত মানুষজনের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। তারা সবাই আজকে জানেন এই কথা।

আসলে জ্ঞান আহরণ করা এবং সেই জ্ঞানকে সমগ্র মানব জাতির পক্ষে কাজে লাগানোর উপযোগী করে তোলা, যাকে আমরা বলি পরিবেশন করা, সেই পরিবেশন সঠিকভাবে করতে তারা জানতেন না। এই কথাটাও সম্পূর্ণ সঠিক বলা হয় না। তারা তাদের উপযোগী অর্থাৎ তার রান্নাবান্না করার সমস্ত লোকজনেদের হাতে ধরে শিখিয়ে দেন সত্যটি-কে। অর্থাৎ রান্নার শাখার লোকদের বা শাখার লোকজনেরা কিন্তু ঠিকই সেই জ্ঞান আহরণ করে ফেলে। আমরা বিজ্ঞানের শাখার লোকজনেরা সেই রান্নার শাখার লোকজনদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখি না। তাই পরিচিত জ্ঞান যা বহুকাল ধরে প্রচলিত। তাকেই আবার নতুন করে শিখতে হচ্ছে নতুনভাবে।

সুতরাং বিজ্ঞানের সম্পর্ক কেবল বিজ্ঞান শাখার মধ্যেই আছে তা ঠিক নয়। বিজ্ঞান সমস্ত শাখা সমস্ত কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে। সুতরাং নতুন বলে দাবী করা সবক্ষেত্রেই সাফল্য পায় না। বিজ্ঞানীর আহরণ করা বিজ্ঞান সত্য যে অনন্য এবং তিনি তার স্রষ্টা এই কথা বলা বেশ মুশকিলের। আজ বিজ্ঞানের আবিষ্কারকদের কিন্তু সেই দিকে বেশ খানিকটা নজর রাখতে হয়।

জ্যামিতির উৎপত্তি এবং সেই জ্ঞানের বিস্তার

এই নিয়ে প্রাচীন পন্ডিত দিগের মধ্যে একটা প্রবলতম বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। এক সময় জ্যামিতির উৎপত্তি এবং সেই জ্ঞানের বিস্তার সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অ্যারিস্টোটল এবং হেরোডোটাস এর মধ্যে একটা বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। একজন মনে করেছিলেন পুরোহিতদের যাগ-যজ্ঞ সম্পর্কিত মাপযোক জ্ঞান যজ্ঞ বেদী মন্দির নির্মাণ এর সম্পর্কে পরিমাপ করতে গিয়ে জ্যামিতি বিদ্যার উৎপত্তি হয়েছে। এবং যার ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছিল নীলনদের বন্যাপ্লাবিত এলাকার পরিমাপ করতে।

অন্যজনে কিন্তু নীলনদের বন্যা প্লাবিত এলাকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপের কথাটা জ্যামিতির উৎস হিসাবে উল্লেখ করেছেন। আদিম সভ্যতা সমুহ পুরোহিতের যাগ-যজ্ঞ সম্পর্কিত পরিমাপ এবং তার জ্ঞানের যে প্রমাণ বহন করে এবং প্রসার ঘটানোতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে কথাটা সকলে স্বীকার করেন না। এই দুই প্রমাণ এর স্বপক্ষে তারা তৎকালীন সমসাময়িক জ্ঞানের পান্ডুলিপি গুলি খুলে বের করেছেন এবং যুক্তির স্বপক্ষে তুলে ধরেছে। আসল বাস্তব সত্যটা হলো এই যে তৎকালীন এই প্রমাণ লেখার কোন রীতি ছিল কি? সুতরাং এই প্রমাণ দ্বারা আমরা কি সঠিক সত্যে উপনীত হতে পারবো? আমরা কি এখন কোনদিনই সেই সত্য উদ্ঘাটন করতে পারব যথার্থভাবে? সুতরাং এই বিতর্ক চিরকালই একটা বিতর্ক রূপে বিরাজ করবে সমাজে।

ইউক্লিড সেই পুরা প্রচলিত খণ্ড-খণ্ড জ্ঞান গুলিকে একত্রিত করে জনসমাজের কাছে প্রকাশ করেছেন এক নিজস্ব ভঙ্গিমায়

অনেকে বলেন ইস্কুল জ্যামিতি হল ইউক্লিডীয় জ্যামিতি । অর্থাৎ ইউক্লিড এই জ্যামিতির সৃষ্টিকর্তা। যাকে ছাত্ররা মনে করে ঐ জ্যামিতিক মৌলিক নীতি গুলি সবই ইউক্লিডের আবিষ্কার করা। এই কথা সত্য নয়। ইউক্লিডীয় জ্যামিতি রীতিনীতি ইউক্লিডের জন্মের বহু পূর্বেই প্রচলিত ছিল খন্ড খন্ড বিভাগে। গুরু মহাশয়দের বিদ্যালয়ে। নিজস্ব ভঙ্গিমায় তারা গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব জ্ঞান ভান্ডার। যে কোন ভান্ডারের জ্ঞান একে অপরের কাছে প্রকাশ পেত না কখনোই যদি না ইউক্লিড সেই টুকরো টুকরো জ্ঞানকে একত্রিত করে নিজস্ব ভঙ্গিমায় প্রকাশ করত। অর্থাৎ ইউক্লিড সেই পুরা প্রচলিত খণ্ড-খণ্ড জ্ঞান গুলিকে একত্রিত করে জনসমাজের কাছে প্রকাশ করেছেন এক নিজস্ব ভঙ্গিমায়। তাই সেই স্কুল জ্যামিতি আজ ইউক্লিডীয় জ্যামিতি তে পরিণত হয়েছে।

সুতরাং বিজ্ঞানের নতুন রীতিনীতি আবিষ্কার করা সেটা এক জিনিস। আবার সেই সমস্ত রীতি নীতি গুলিকে একত্রিত করে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রচার করা এক জিনিস। দুটি আলাদা কাজের কিন্তু আলাদা রকম গুরুত্ব আছে। তাই বলে এই দুটি কিন্তু মৌলিক জ্ঞান নয়। একটি জ্ঞানকে মৌলিকতার আসন দিলেও অপরটিকে মৌলিকতার আসন দেওয়া যায় না। অপরদিকে প্রসারকের আসন দেওয়া যেতে পারে।

আসলে শিক্ষিত ও জ্ঞানীরা সহজেই একটি শিক্ষাকে সঙ্গী করে সেই নিয়ে নানান পথ পাড়ি দিতে পারে। কিন্তু অশিক্ষিতরা তারা সেই পাড়ি দিতে পারেনা। অর্থাৎ এদের মধ্যে যে বিজ্ঞানের জ্ঞান রয়েছে সেই বিজ্ঞানের জ্ঞান তাদের মধ্যে সীমিত অবস্থাতেই রয়ে গেছে তার কোন বৃদ্ধি ঘটে নি। যাকে বলে গুঢ় অর্থেই সীমিত থাকা। নতুন কিছু উদ্ভাবন করা বা সার্বজনীন জ্ঞানে উন্নীত করা ঘটে না।

শিক্ষিতরা কিন্তু সেই উন্নীতকরণ ঘটাতে পারে। শিক্ষার জ্ঞান সেই উন্নীতকরণ ভাবনায় তাকে চালিত করতে পারে এবং যথাপোযুক্ত ভাবে বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। সুতরাং একে অশিক্ষা বলা যায় না। তবে আমাদের প্রথাগত শিক্ষাও বলা যায় না। আবার শিক্ষিত হলেও সবাই বিজ্ঞান বোঝেন এ কথা সত্য নয়

বিজ্ঞানের রুক্ষতা শুষ্কতা মরুভূমির ন্যায় পরিবেশ যেমন অন্য পরিবেশ থেকে স্বতন্ত্র তেমন বিজ্ঞান শিক্ষার অন্য শাখার সঙ্গে সম্পর্কে হীন নয়। এই কথা শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলে এক বাক্যে স্বীকার করে না। সুতরাং তারা অশিক্ষিত নয়। তারা হল অজ্ঞ। অর্থাৎ কথাখানা শিক্ষিত আর অশিক্ষিত নয়। কথাটি হল অজ্ঞ আর বিজ্ঞ। এদের মধ্যে ভুলের ব্যাখ্যা যিনি দিতে পারেন, যিনি বিশ্লেষণ করতে পারেন তিনি বিজ্ঞ। আমাদের বিজ্ঞান কিন্তু সেই পথেই চলে আজ সর্বোচ্চ।

বিজ্ঞানের ভুল ভ্রান্তি গুলো আজো কেন অধরা রয়েছে?

আমাদের বিশাল জনসমুদ্রের ভারতের গ্রামে গ্রামে এমন বিজ্ঞানের বহু জ্ঞানী রয়েছে যারা বিজ্ঞান সত্যটা জানেন কিন্তু প্রথাগতভাবে বিজ্ঞান জানেন না। তাই বিজ্ঞানের ভুল ভ্রান্তি গুলো আজো অধরা রয়েছে। হাতে কলমে কাজ করা মানুষ গুলো প্রকৃত বিজ্ঞান অজ্ঞ। আর সেই বড় অংশের হাতে কলমের মানুষ গুলো রয়েছে বিজ্ঞানের মূল স্রোত থেকে দূরে। একটা ঘটনায় আমার বক্তব্য একটু পরিষ্কার করি।

আমরা গাছের পাতা দেখে বহু ক্ষেত্রে গাছ চিনতে পারি সরল বিভাগ দ্বারা। পাতার বিভাগ অঙ্গ সংস্থানগত এক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তা সীমিত রয়েছে একটা সময়ের মধ্যে। উদ্ভিদের পাতার বিভাগ করা হয় তার পরিণত অবস্থায়। কিন্তু আগাছা নির্বাচন করে আলাদা করা হয় অপরিণত অবস্থাতে। পরিণত ও অপরিণত গাছের অঙ্গ সংস্থানগত বহু পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং ঐ একটি জ্ঞানে বিজ্ঞান সত্যটি সীমিত থাকে না। প্রয়োজন পড়ে পাতার প্রকৃতিগত জ্ঞানের পরিবর্তন ঘটানোর। এইটি প্রথাগত শিক্ষায় অজ্ঞ চাষা জানে না। কিন্তু বিজ্ঞান সত্যটাকে জানে।

সুতরাং আমাদের দরকার, হয় তাদেরকে বিজ্ঞ করতে হবে নতুবা আমাদের বিজ্ঞ হতে হবে হাতে কলমের জ্ঞানে। তাহলেই এক দিন আমরা বিজ্ঞানে স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে পারবো।

লেখক পরিচিতিঃ-

মনোরঞ্জন ঘোষাল

Vill Atmarampur
PO Paschimrameswarpur
PS Budge Budge
Dists 24 Parganas, Pin 700140

Originally published at https://bijnan-o-bijnani.co.in on January 13, 2021.

--

--

Sayantani Banerjee

A designer by passion, a writer by choice, a digital marketer by profession